সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদাকে একদল উচ্ছৃঙ্খল জনতা রোববার রাতে রাজধানীর উত্তরার বাসা থেকে বাইরে বের করে এনে পুলিশে সোপর্দ করে। এর আগে তারা নুরুল হুদার গলায় জুতার মালা পরিয়ে অপদস্থ করে। এ নিয়ে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, নুরুল হুদাকে ঘিরে ধরে সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত এক ব্যক্তি জুতার মালা থেকে একটি জুতা নিয়ে সাবেক সিইসিকে মারধর করছে।
এ সময় নুরুল হুদাকে উদ্দেশ করে ওই ব্যক্তি বলতে থাকে, ‘ওহ যে স্বৈরাচার সৃষ্টি করেছে, এটা ওর উপহার। ওহ আর স্বৈরাচার সৃষ্টি করতে পারবে না।’ পরে পেছন থেকে অন্য আরেকজন জুতার মালাটি খুলে নিলে সাবেক সিইসিকে হেফাজতে নেয় পুলিশ। আরেকটি ভিডিওতে এ সময় নুরুল হুদাকে ঘিরে ধরে ‘স্বেচ্ছাসেবক উত্তর’ এর নামে স্লোগান দিতে শোনা যায় কথিত জনতাকে।
সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত ওই ব্যক্তির নাম মোজাম্মেল হক ঢালী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তিনি উত্তরার স্থানীয় বাসিন্দা। তবে বিএনপিতে তার কোনো পদ-পদবি নেই।
স্বেচ্ছাসেবক দলের এক কেন্দ্রীয় নেতা জানান, বিএনপি কিংবা অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ওয়ার্ড, থানা বা মহানগর—কোনো পর্যায়ের কমিটিতেই মোজাম্মেল ঢালী নেই; অতীতেও কখনো ছিল না। তবে মোজাম্মেল ঢালী স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। তিনি দলে পদ-পদবি পেতে চান।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি শেখ ফরিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, মোজাম্মেল হক ঢালী আমাদের দলীয় কোনো লোক না। কোনো পদ-পদবিতে নেই। তিনি বলেন, এ ঘটনায় কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দল এবং ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের পক্ষ থেকে দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আশা করি, আগামীকাল (আজ) তদন্ত রিপোর্ট পাব। আমাদের সংগঠনের কেউ ‘মব’ সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত থাকলে তার বা তাদের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সে যে পর্যায়ের নেতাই হোক।
এদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে এরই মধ্যে বলা হয়েছে, মব সৃষ্টি করে সাবেক সিইসি নুরুল হুদার সঙ্গে অসদাচরণে দলের কেউ জড়িত থাকলে তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ‘ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন’ নেওয়া হবে।
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ গতকাল গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমরা মব কালচারে বিশ্বাস করি না, আমরা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য অবিরাম সংগ্রাম করে যাচ্ছি। আমরা চাই, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং আদালতের রায় বাস্তবায়ন হবে, বিচার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা থাকবে। সুতরাং সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া এবং বিচার প্রক্রিয়া আইনগতভাবে যথাযথভাবে পরিচালিত হবে, এটা আমরা প্রত্যাশা করি। তবে তার সঙ্গে যে অবমাননাকর ব্যবহার করা হয়েছে, এটা আমরা সমর্থন করি না। এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। যদি বিএনপির যে কোনো নেতাকর্মী এ ঘটনায় জড়িত থাকে, তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন (শৃঙ্খলাবিরোধী ব্যবস্থা) আমরা নেব। এটা আমাদের (বিএনপি) অবস্থান। তিনি আরও বলেন, আমরা চাই—কোনো ব্যক্তি যত বড় অপরাধীই হোন না কেন, তার আইনি এবং সাংবিধানিক অধিকার যেন ভোগ করার অধিকার অক্ষুণ্ন থাকে।
অন্যদিকে, কে এম নুরুল হুদার সঙ্গে হওয়া ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি দাবি করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। গতকাল তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, বাংলাদেশে শান্তি, স্বস্তি এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য বিএনপি কাজ করে যাচ্ছে। গণতন্ত্রমনা মানুষ যাতে গণতন্ত্র চর্চা করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে বিএনপি বদ্ধপরিকর। তবে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনো কোনো দল ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে চাচ্ছে। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, ৫ আগস্টের পর থেকে আমাদের দলের চেয়ারপারসন এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন যে, দলের ভেতর কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী এবং অনৈতিক কাজে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আমরা তখন যারা কারাগারে ছিলাম, জেলে থেকেও সবাইকে সুশৃঙ্খল রাখার চেষ্টা করেছি। এখন পর্যন্ত বিএনপির যেসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেসব অভিযোগের ভিত্তিতে চার সহস্রাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
নুরুল হুদাকে হেনস্তার ঘটনায় পুলিশের জিডি: সাবেক সিইসি কে এম নুরুল হুদাকে মব সৃষ্টি করে হেনস্তার ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে পুলিশ। গতকাল রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের উত্তরা বিভাগের ডিসি মো. মহিদুল ইসলাম কালবেলাকে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেছে। মব সৃষ্টি করে লাঞ্ছনার ঘটনায় জিডি করা হয়েছে। আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি। কারা কারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, সেই বিষয়টি আমরা তদন্ত করব। নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, সাবেক সিইসি নুরুল হুদাকে আটকের সময় যেভাবে ‘মব’ সৃষ্টি করা হয়েছে, তা কাম্য নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে এ ধরনের ঘটনায় বাহিনীর কেউ জড়িত থাকলে, তা তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।