প্রতিটি যুদ্ধবিরতি এক সম্ভাবনা—শান্তির সম্ভাবনা। আর শান্তি মানুষের জীবনের জন্য অপরিহার্য। মানুষ হিসেবে আমরা বাঁচি শিখতে, শিখি সঠিকভাবে বাঁচতে। আমরা চাই ঠিকভাবে বাঁচতে যেন ভুল না করি, আর ভুল এড়িয়ে চলি যেন মানবিক দায়িত্ব পালনে সক্ষম হই—সেই দায়িত্ব ঈশ্বরের প্রতি যেমন, তেমনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতিও।
ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে, কিছু পশ্চিমা রাষ্ট্র যখন পূর্বের দেশগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে কিংবা নিজেদের নীতি বাস্তবায়ন করতে চেয়েছে, তখন তারা বহুবার সমস্যায় পড়েছে—কারণ তারা পূর্বের ভেতরের বাস্তবতা, সক্ষমতা ও সাংস্কৃতিক কাঠামো যথাযথভাবে বুঝতে পারেনি। পশ্চিম যেখানে বাহ্যিকতা দিয়ে বিচার করে, পূর্ব সেখানে তার আসল শক্তিকে আড়াল করে রাখে—মানবশরীরের অন্তর্নিহিত শক্তির মতো, যা শুধু চলমানতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়।
এইবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ১১ দিনের রক্তপাতের পর, যখন কেউ জানে না যুদ্ধবিরতি স্থায়ী হবে কি না, নাকি লেবাননের মতো কেবল সাময়িক বিরতি হবে—যার মাধ্যমে প্রতিপক্ষ নতুন করে আঘাত হানার প্রস্তুতি নিতে পারে—তবুও কিছু শিক্ষা আমাদের নিতে হবে।
ইরানের জন্য এই যুদ্ধ কী সুযোগ এনেছিল?
প্রমাণ করার যে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান ও এর জনগণই প্রাচীন পারস্য সভ্যতার প্রকৃত উত্তরসূরি। দেখানোর যে সরকারের সঙ্গে জনগণের সমর্থন রয়েছে এবং সরকার তার অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা মূল্যায়নে সক্ষম। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনী হচ্ছে জনগণের সেনাবাহিনী। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়ার, যে কোনো সরকার যদি জনগণের সমর্থন হারায়, তাহলে তার দীর্ঘকাল টিকে থাকা সম্ভব নয়। তাই জনগণের মূল্য সবসময় বোঝা উচিত।
জনগণ যেন উপলব্ধি করে যে দেশের প্রকৃত নিরাপত্তা নির্ভর করে জ্ঞান, বিজ্ঞান, ধৈর্য, ঐক্য ও সংহতির ওপর—কোনো বিদেশি বা দেশীয় রাজনৈতিক বুলি দিয়ে নয়। অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান দেশের মধ্যেই নিহিত। উপলব্ধি করার যে, একজন বিজ্ঞানীকে হত্যা করে জ্ঞানকে হত্যা করা যায় না—কারণ জ্ঞান অমর। বুঝে নেওয়ার যে ২১শ শতকেও কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক আইন যতটা জরুরি, বাস্তবে উন্নত সামরিক প্রযুক্তি ছাড়া তা প্রায় অকার্যকর।
স্মরণ রাখার যে মানুষ এবং দেশ—উভয়েই প্রকৃতভাবে চেনা যায় সংকটকালে। সেখানেই প্রকৃত বন্ধু ও শত্রুর পরিচয় স্পষ্ট হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, এমনকি ইসলামি বিশ্বেও এখনও কিছু প্রতিবেশী ও নব-উত্থিত রাষ্ট্র রয়েছে, যাদের কাছে জাতীয় স্বার্থ, অর্থনৈতিক লাভ ও পরিবারভিত্তিক সরকার ইসলামী ভ্রাতৃত্ব, সম্মান ও প্রতিবেশী হিসেবে দায়িত্ববোধের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা এর কারণ জানি না। হতে পারে, তাদের এখনও ২,০০০ বা ৩,০০০ বছর এই অঞ্চলে বসবাস করতে হবে—এই মূল্যবোধগুলো বোঝার জন্য। প্রতিবেশীর ঘরে আগুন লাগলে হাতে জলভরা বালতি নিয়ে ছুটে যেতে হয়—বোমা নয়। কারণ, আজকের আগুন কাল আপনার ঘরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রমাণ করার যে গত ৪০ বছরে ইরানের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ও স্বনির্ভরতা।
আঞ্চলিক ও প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য এটি ছিল একটি উপলক্ষ। ইরানের বাস্তব সামর্থ্য ও কঠোর নীতিগত অবস্থান বুঝে নেওয়ার এবং সেই অনুযায়ী নিজেদের নীতিমালা তৈরি করার। বোঝার যে সংকটকালে কোন দেশ কীভাবে রাজনৈতিক আচরণ করে, তা ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। নিজেদের অভ্যন্তরীণ সক্ষমতার ওপর নির্ভরতা ও আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির। উপলব্ধি করার যে ন্যায়বিচার ও তার প্রাপ্তি আমাদের মধ্যেই নিহিত—এবং তার জন্য আমাদের প্রতিরোধের মানসিকতা কতটা প্রস্তুত, তা-ই নির্ধারণ করে এর ফলাফল। বুঝে নেওয়ার যে জীবন নিজেই এক প্রতিরোধ। জন্ম প্রতিরোধ, বেঁচে থাকা প্রতিরোধ, মৃত্যু প্রতিরোধ। এবং ন্যায়ের সন্ধানও এক প্রতিরোধের নাম।
১৯১৫ সাল থেকে আজ পর্যন্ত আমরা ন্যায়ের জন্য লড়ছি—যেসব অপরাধ তথাকথিত “সভ্য জগতের” চোখের সামনে সংঘটিত হয়েছে, ২০২৩ সালে কারাবাখে আবার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। কেউ কাঁদেছে, কেউ লিখিত নিন্দা জানিয়েছে, কেউ মৌখিক সহানুভূতি দিয়েছে—কিন্তু ফলাফল একই: কিছুই হয়নি। স্থায়ী শান্তি রক্ষাও একইভাবে এক প্রতিরোধ। শান্তি সবসময় ঝুঁকির মুখে থাকে—কারণ এই বিশ্বের একটি অংশ ‘অসুরীয়’।
তাই মর্যাদাপূর্ণ শান্তির মূল্য আমরা যেন সবসময় স্মরণ করি এবং তাকে ধরে রাখতে সর্বদা সচেষ্ট থাকি। এই অঞ্চল আমাদের বড় একটি সম্মিলিত ঘর—এটি নিরাপদ রাখা আমাদের সকলের দায়িত্ব। স্থায়ী শান্তির প্রত্যাশা এবং ন্যায়ের বিজয়ের আশায়।
লেখক: ইতিহাস বিশ্লেষক, অরবেলি সেন্টার।